'এই পৃথিবী আমার জন্য ছিল না', জীবনের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে আত্মঘাতী নোট গবেষকের
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা - শুক্রবার পিএইচডি গাইড ও সহ গবেষকদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে আত্মঘাতী হয়েছেন আইআইএসইআর কলকাতার এক গবেষক। নাম অনামিত্র রায়। এই মৃত্যুর পিছনে লুকিয়ে আছে প্রবল যন্ত্রণা সহ বহু অজানা তথ্য। ইনস্টিটিউটটে র্যাগিং থেকে শুরু করে ছাত্রদের মানসিক নির্যাতন নতুন নয়। সিনিয়রদের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে শেষে বেছে নিতে হয় সুইসাইডের পথ। ঠিক তেমনই করেছেন অনামিত্র। তবে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকলের সপক্ষে একটি আত্মঘাতী চিঠি লিখে যান। যেখানে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়ের বিবরণ সহ পিএইচডি গাইড ও সহ গবেষকদের নাম উল্লেখ করেন তিনি। তবে বিচারের আগেই না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন।
উত্তর ২৪ পরগণার শ্যামনগরের বাসিন্দা ওই অনামিত্র। গবেষণারত নদিয়ার কল্যাণীর আইসার কলকাতায়। সমাজমাধ্যমে লেখা চিঠিতে ওই গবেষক উল্লেখ করেছেন, তিনি অটিজ়মে আক্রান্ত। শৈশব থেকেই তাঁকে নানা ভাবে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। বাড়িতেও তার সঙ্গে নানা সময়ে দুর্ব্যবহার করতেন তাঁর বাবা-মা। গবেষক লিখেছেন, তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন, সেই সময় হেনস্থার শিকার হয়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মানসিক অবসাদে চলে গিয়েছিলেন। এছাড়াও ইনস্টিটিউটে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনার বিবরণ রেখে গিয়েছেন। সবশেষে অনুরোধ জানিয়েছেন খুব দ্রুত ন্যায়বিচার পাইয়ে দিয়ে তাঁকে যেন সারাজীবন মনে রাখা হয়।
গবেষক তাঁর নোটে লিখেছেন, "আমি ও আমার অনেক সহকর্মী, আমাদের ল্যাবের পিএইচডি ছাত্র সৌরভ বিশ্বাসের কাছ থেকে বারবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বহুবার অভিযোগ করেও আমাদের সুপারভাইজার অনিন্দিতা ভদ্র কোনো ব্যবস্থা নেননি। ২০২৫ সালের ১২ই এপ্রিল ল্যাবে সৌরভ বিশ্বাস আমাকে দীর্ঘ সময় ধরে চিৎকার করে অপমান করে। আমি ইমেল এবং অফিশিয়াল পোর্টালের মাধ্যমে আইআইএসইআর কলকাতার অ্যান্টি র্যাগিং সেলে অভিযোগ জানাই। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।"
গবেষক তাঁর লেখায় যোগ করেছেন, "স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের একজন সদস্য আমাকে সমর্থন করলেও আরেকজন বলেছিলেন যে অভিযোগ করার আগে আমার ল্যাবের সুনাম নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। আমার সুপারভাইজারের মতও প্রায় একই তিনিও শুধু আমার আচরণের দোষ খুঁজলেন। কয়েকদিন পর আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু কাকতালীয় কারণে তা ঘটেনি। আমি আবারও থেরাপি ও ওষুধের সহায়তা নিয়েছি, আর কোনোমতে বেঁচে ছিলাম এতদিন।"
অনামিত্র জানিয়েছেন তার সঙ্গে নির্যাতকের সঙ্গে নাকি সকলেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি লিখেছেন, "আমার নির্যাতকের সঙ্গে সবাই স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখছিল। কেউ আমার দিকটা একবারও খতিয়ে দেখেনি। তাই আমার মানসিকভাবে ভেঙে পড়া স্বাভাবিক ছিল। তার মধ্যে একবার প্রকাশ্যেও ঘটেছিল। আমি শুধু সোরভ বিশ্বাসের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটাও আমাকে দেওয়া হয়নি। আজ সকালে আমার দিন শুরু হয় আমার সুপারভাইজারের মুখে আমার নির্যাতক সহ তার কাজের প্রশংসা ও উদযাপন দিয়ে। যদিও তার থিসিসে প্রচুর বৈজ্ঞানিক অনিয়ম আছে। তা সত্ত্বেও সুপারভাইজার তার প্রশংসা করেন ও ভুলগুলি ঢেকে রাখেন।আমি প্রতিবাদ করতেই তিনি আবার আমাকে তিরস্কার করলেন।"
নির্যাতক সকলকে অনুরোধ করেছেন এই ঘটনার একটা বিহিত যেন করা হয় ও তাঁকে যেন সারাজীবন মনে রাখা হয়। তিনি লিখেছেন, "আমি যদি আপনার জীবনে সামান্যতম ইতিবাচক প্রভাবও রেখে থাকি, দয়া করে চেষ্টা করুন যেন আমার নির্যাতক সোরভ বিশ্বাস তার পিএইচডি না পায় এবং অ্যান্টি-র্যাগিং আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার পায়।
সর্বশেষ তিনি লিখেছেন, "এই পৃথিবী আমার জন্য ছিল না বোধহয়। হ্যাঁ, কিছু ভালো মানুষ, কিছু বন্ধুর ভালবাসা পেয়েছিলাম। তবে আমি আর পারছি না। জীবনের হাল আমি ছেড়ে দিয়েছি। জীবনে সে শান্তি পাইনি, হয়তো মৃত্যুর পর পাব। যাই হোক, আমি জীবনে যত কষ্ট ও দুঃখ দিয়েছি, আর এখন আমার মৃত্যুর মাধ্যমে যে কষ্ট দেব তার জন্য গভীরভাবে দুঃখিত। যদি আমাকে কেউ মনে রাখে। আমি চাই আমাকে মনে রাখা হোক। আমি জীবনে অনেককে দয়া দেখিয়েছি। অন্তত সেই কারণে যেন আমায় সবাই মনে রাখে।"